আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সমাজ-সংস্কৃতিতে অসংখ্য শাস্তির উদাহরণ পাওয়া যায়। এসব শাস্তির রীতির মধ্যে অনেক গুলোই কঠোর-নির্দয়। তবে জীবন্ত সমাধিস্থ করার শাস্তি হয়তো সব নির্মমতাকেই ছাড়িয়ে যায়। পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্য সব জায়গায়ই এই নির্মম রীতি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন রোমে ভিস্তা দেবীর সেবায় নিয়োজিত ভেস্টাল ভার্জিনরা সতীত্ব ভাঙলেই তাদের জীবন্ত সমাধিস্থ করা হতো।
জীবন্ত সমাধিস্থ করার এই নির্মম রীতিকে ‘ইমিউরেমেন্ট’ বলা হয়। এর মাধ্যমে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোনো প্রকার মুক্তির সুযোগ ছাড়াই একটি সীমাবদ্ধ জায়গার মধ্যে আমৃত্যু আবদ্ধ করে রাখা হতো। সাধারণত, ডিহাইড্রেশন বা অনাহারে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই জায়গাতেই আটকা থাকতো শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি। আবার জীবিত কবর দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকের শ্বাসকষ্ট মৃত্যু হতো।
‘ইমিউরেমেন্ট’ মৃত্যুদণ্ডের একটি ধরন হিসাবে বিবেচিত হলেও এটির অন্যান্য বেশ কয়েকটি কারণও রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- মানব বলি বা তাপস্যের উদ্দেশ্য। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সময় ও সংস্কৃতিতে ‘ইমিউরেমেন্ট’র উদাহরণগুলো পাওয়া যায়। এছাড়া ইমিউরেমেন্টের শিকার লোকেদের বিষয়ে অনেক লোককাহিনি রয়েছে। অনেক সময়, ‘ইমিউরেমেন্ট’র শিকার লোকেদের কঙ্কালগুলো প্রাচীরের আড়ালে সিলযুক্ত অবস্থায়ও পাওয়া গিয়েছে।
‘ইমিউর’ শব্দটি যথাক্রমে ল্যাটিন শব্দ ‘ইন’ ও ‘মুরুস’ থেকে এসেছে। ‘ইন’ অর্থ ‘ভেতরে’ আর ‘মুরুস’ অর্থ ‘দেয়ালে’। এই শব্দটির উৎপত্তি মধ্যযুগীয় লাতিন শব্দ ‘ইমিউরারে’ থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘দেয়ালের মধ্যে বদ্ধ হয়ে যাওয়া’। এই শব্দের ল্যাটিন উৎস বিবেচনা করে গবেষকদের ধারণা, প্রাচীন রোমেই হয়তো ‘ইমিউরেমেন্ট’র যাত্রা শুরু হয়েছিল।
প্রাচীন রোম ও ভেস্টাল ভার্জিনদের শাস্তি
প্রাচীন রোমে ‘ইমিউরেমেন্ট’র প্রচলন ছিল। সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভেস্টাল ভার্জিনরা এর শিকার হতো। রোমান দেবী ভেস্তার সেবা করা কুমারী সন্ন্যাসিনী দেরকেই ভেস্টাল ভার্জিন বলা হয়। তারা সতীত্বের ব্রত ভঙ্গ করলে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। যার শাস্তি ছিল নির্মমভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। এই সন্ন্যাসিনীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য ছিল ভেস্তার মন্দিরে চিরস্থায়ী আগুনকে রক্ষা করা। যে আগুন শহরটির ভেস্তার সুরক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতো এবং এই পবিত্র শিখা নিভে যাওয়া ভয়াবহ শুভ কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো। ভেস্টাল ভার্জিনদের রোমের ভালোমন্দ দেখারও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এসবের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ সুযোগ-সুবিধাও পেতো তারা।
তবে, কোনো ভেস্টাল ভার্জিন নিজের কর্তব্য অবহেলা করলে তাকে ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হতো। সতীত্বের ব্রত ভঙ্গ করা একজন ভেস্টাল ভার্জিনের জন্য সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। কারণ, তারা সতীত্বের ব্রত রক্ষার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতো, সেকারণেই এটি বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য হিসাবে বিবেচিত ছিল প্রাচীন রোমের বাসিন্দাদের কাছে। সতীত্ব ভাঙা ভেস্টাল ভার্জিনদের আমৃত্যু একস্থানে আটকে দেওয়া হতো।
রোমান লেখক প্লিনি দ্য ইয়ুঙ্গার-এর একটি চিঠিতে এমন শাস্তি প্রাপ্ত একজন ভেস্টাল ভার্জিনের শেষ পরিণতির বর্ণনা পাওয়া যায়। সম্রাট ডোমিশিয়ান কর্তৃক কর্নেলিয়া নামের একজন ভেস্টাল ভার্জিনের ‘ইমিউরেমেন্ট’ সম্পর্কে নিজের এক বন্ধুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন প্লিনি দ্য ইয়ুঙ্গার। এছাড়া অ্যান্থন স্মিথের লেখাতেও ভেস্টাল ভার্জিনদের এমন মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা পাওয়া যায়।
মঙ্গোলদের জীবন্ত সমাধি
‘ইমিউরেমেন্ট’ সাধারণত শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও অন্যান্য উদ্দেশ্যেও এটি করা হতো। মানব বলিদান যার অন্যতম প্রকার। অভিজাতদের তাদের চাকর বা দাসদের সাথে সমাধিস্থ করার কাহিনি বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃতিতে পাওয়া যায়। এটা বিশ্বাস করা হতো যে, এই লোকদের এমনভাবে বলি দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা তাদের মনিবদের পরকালীন জীবনেও সঙ্গ দিতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে, বলির শিকার ব্যক্তিদের দাফনের আগে হত্যা করা হয়েছিল। আবার জীবন্ত কবর দেওয়ার উদাহরণও আছে। মরক্কোর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতার ‘রিহলা’তেও এমন উদাহরণ পাওয়া যায়। ‘রিহলা’ ইংরেজিতে ‘ট্র্যাভেলস অব ইবনে বতুতা’ নামেও পরিচিত। ১৩২৫ থেকে ১৩৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ইবনে বতুতা মোট ১ লাখ ২০ হজার কিলোমিটার (৭৫ হাজার মাইল) ভ্রমণ করেছিলেন। সে সময়কার প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশ ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। এমনকি দূর প্রাচ্যের চীন পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন।
ইবনে বতুতার চীন সফরের সময় সেখানে মঙ্গোল ইউয়ান রাজবংশের শাসন প্রচলন ছিল। তিনি সেখানকার মানব বলি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। ইবনে বতুতার বর্ণনা মতে, মৃত একজন খানকে (শাসক) চারজন জীবন্ত মহিলা দাস এবং তার ছয়টি প্রিয় মামলুকসহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল। যদিও ইবনে বতুতা এই শাসকের নাম উল্লেখ করেননি। যেহেতু চীন সম্পর্কে তার বর্ণনাটি যথেষ্ট অস্পষ্ট তাই ঐতিহাসিকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, ইবনে বতুতা আসলেই চীন ভ্রমণ করেছিলেন কিনা।
ইনকা শিশুদের জীবন্ত সামধির ঘটনা
তথাকথিত ‘লুল্লাইলাকোর শিশু’ বা ‘লুল্লাইলাকোর মমিদের’ ক্ষেত্রে ইবনে বতুতার বর্ণার শাসকের সঙ্গে জীবিত দাসদের সমাহিত করার বিবরণ থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন প্রকৃতির বলে গণ্য করা যেতে পারে। চিলি এবং আর্জেন্টিনার সীমান্তে যেসব অঞ্চল একসময় ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল সেখানে শিশুদের মমি পাওয়া যায়। যেগুলোকে ‘লুল্লাইলাকোর শিশু’ বা ‘লুল্লাইলাকোর মমি’ও বলা হয়। সেখানে তিনটি মমি আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৯ সালে। যাদের নাম দেওয়া হয় লুল্লাইলাকোর মেইডেন, লুল্লাইলাকোর বয় এবং লাইটেনিং গার্ল। মমিগুলোর জৈব রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হয়। সেখান থেকে জানা যায় তাদের তাপস্যের উদ্দেশ্যে তাদের জীবন্ত সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
রাসায়নিক পরীক্ষা থেকে জানা যায়, লুল্লাইলাকো মেইডেনের মৃত্যুর সময় ১৩ বছর বয়সী ছিল। সে ভুট্টা ও পশুর প্রোটিন জাতীয় অভিজাত খাবার গ্রহণ করছিল। একই সময়ে, তার কোকা এবং চিচা খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, এটি ভেজানো ভুট্টা থেকে তৈরি অ্যালকোহল। গবেষকদের ধারণা, এই অ্যালকোহল লুল্লাইলাকো মেইডেনকে উন্মাদ করে দিতো। এমনকি তার বলিদানের দিন তাকে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়েছিল।
সূত্র- অ্যানসিয়েন্ট অরিজিন