মির্জা শামীম হাসান সনি। কখনো প্রকৌশলী, কখনো আইনজীবী, আবার কখনো সাংবাদিক, লেখক, কবি! যখন যেমন প্রয়োজন, তখনই এমন সব কৌশলী পরিচয়ে হাজির তিনি। তবে যে পরিচয়টা এত দিন কাউকে ঘুণাক্ষরে জানতে দেননি, সেটাই এবার খুঁজে বের করল বগুড়ার সাইবার ক্রাইম পুলিশ। সনি একজন বিকৃতমনা ধূর্ত সাইবার অপরাধী। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে কুৎসা ছড়ানো, ছবি দিয়ে মানহানিকর মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে চাতুরী করাই তাঁর এক অদ্ভুত নেশা।
বগুড়ার এক নারী সাংবাদিকের ছবি দিয়ে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগে গত শুক্রবার রাজধানীর পশ্চিম রামপুরা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় জব্দ করা হয় তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার ডিভাইস। পুলিশ তাঁর মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার ডিভাইস ঘেঁটে তিন শতাধিক মেয়ের ছবি, অডিও ও শতাধিক ভুয়া ই-মেইল, ফেসবুক আইডির খোঁজ পেয়েছে। ৩১ বছর বয়সী সনির দাবি, তিনি রাজধানীর নামকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভনিং এমবিএ করছেন।
সনির ফাঁদ : সুন্দরী কিংবা সুশ্রী তরুণী দেখলে সনি আগে প্রলুব্ধ করেন। ওই তরুণীদের নাম দিয়ে ফেসবুকে গল্প ও কবিতা প্রকাশ করতেন নিজেই। এরপর কৌশলে ওই সব তরুণীর সঙ্গে অনলাইনে অশ্লীল চ্যাট করার ফন্দি আঁটেন। সাড়া না পেলে ভিন্ন উপায়ে ছবি ও বায়োডাটা সংগ্রহের চেষ্টা চলে। এরপর ভুয়া ই-মেইল ও ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে মেয়েটির নামে শুরু হয় কুৎসা রটানোর কাজ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সনি তাঁর নারী ফাঁদের কথা স্বীকার করে পুলিশকে জানিয়েছেন, কোনো নারীকে বিয়ে করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়, তাঁর নেশা অশ্লীল চ্যাটিং, কুৎসা রটানো এবং মিথ্যা তথ্য ও ছবি দিয়ে ভয় দেখিয়ে ওই নারীকে নিজের কবজায় রাখা। বিকৃতমনা এই অপরাধই তাঁকে ইন্টারনেটের অন্ধকার জগতের পথ চিনিয়েছে।
যেভাবে ধরা সনি : গত ২০ জুন বগুড়ার এক নারী সাংবাদিকের চরিত্র নিয়ে মিথ্যা ও কাল্পনিক তথ্য তুলে ধরে একটি ই-মেইল ২০০ স্থানীয় সাংবাদিকের কাছে পাঠান সনি। ভুয়া ঠিকানা থেকে ই-মেইলটি পাঠানোর পরই আইডিটি অকার্যকর করে দেওয়া হয়। পরে বিষয়টি ভুক্তভোগী ওই নারী বগুড়ার পুলিশ সুপারকে জানান। এক পর্যায়ে বগুড়া সদর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় জেলা পুলিশের সাইবার ইউনিটকে। তাদের বিশেষজ্ঞদল উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুয়া ই-মেইলের পেছনের কারিগরকে খুঁজে বের করে ফেলে।
বগুড়া পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা জানান, ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে আসামির অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর গত শুক্রবার ঢাকার হাতিরঝিল থানা এলাকার ২১১/বি উলন, পশ্চিম রামপুরার একটি ভবন থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি সব অপকর্মের কথা স্বীকার করেছেন। পুলিশের তদন্তেও তাঁর সাইবার অপরাধ কীর্তির অনেক প্রমাণ মিলেছে।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আলী হায়দার চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে জেলা সাইবার ইউনিটের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক এমরান মাহমুদ তুহিন ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শওকত আলমসহ একটি দল ফাঁদ পেতে ধূর্ত এই সাইবার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি পাগলের বেশভূষা ধরে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। বগুড়ার সারিয়াকান্দির জোরগাছা গ্রামের মির্জা সেলিম রেজার ছেলে তিনি। সনি এখন থাকেন বগুড়া সদর উপজেলার ছিলিমপুর এলাকায়।
পুলিশ যা বলছে : জেলা পুলিশের সাইবার ইউনিটের ইনচার্জ (পরিদর্শক) এমরান মাহমুদ তুহিন বলেন, ভুক্তভোগী নারীর নাম ও ছবি ব্যবহার করে তাঁর চরিত্র নিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য তুলে ধরে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে ই-মেইল করতেন সনি। এ ব্যাপারে গত ২৫ জুন বগুড়া সদর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন এক ভুক্তভোগী নারী।
জানা যায়, সনির শিকারে রয়েছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার অর্ধশতাধিক সুন্দরী তরুণী। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবীও রয়েছেন। সুন্দরী এসব নারীর নাম ও ছবি ব্যবহার করে সনি তৈরি করেন ২৫টিরও বেশি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। আলাদা ই-মেইল আইডি ব্যবহার করে খোলা এসব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তিনি শুধু অপরাধমূলক কাজ ও টার্গেট করা তরুণীদের কবজায় নিতে ব্যবহার করতেন। ধূর্ত সনি যেকোনো আইডি খুলে মেসেজ পাঠানোর পরপরই সেই ই-মেইলটি ব্লক করে দিতেন, যাতে কখনো তাঁর অবস্থান ও কম্পিউটারের আইপির ঠিকানার খোঁজ না পাওয়া যায়। এসব অনৈতিক কাজ করার জন্য তিনি ৯৬টি ই-মেইল আইডি খুলেছিলেন। সাইবার বিশেষজ্ঞদের চোখ ফাঁকি দিতে জি-মেইল ও ইয়াহুর পাশাপাশি অভি, লাইভ, হটমেইল, আউটলুক, উইকিমিডিয়া, ওয়াই মেইল, কেহিপা, কেয়ারফুল, এমআইজি ৩৩, প্রটনমেইল, ইয়ারডেক্স ও জোহারের মাধ্যমে ই-মেইলের আইডি খোলা হয়েছিল। পরিচয় ও কণ্ঠ গোপন রেখে অন্য করোর সঙ্গে কিভাবে চাতুরী করা যায় তা রপ্ত করতে ইউটিউবে শত শত টিউটরিয়াল দেখে নিজেকে তৈরি করেন সনি। একই সঙ্গে যে তরুণীকে সনি টার্গেট করতেন তাঁর পরিবারের সদস্য, সহকর্মী ও স্থানীয় সাংবাদিকদের ই-মেইল আইডি সংগ্রহে নিতেন তিনি। পরে মনগড়া ও কুিসত কথাবার্তা লিখে সেই তরুণীকে সমাজে হেয় করার চেষ্টা করতেন।
সাইবার অপরাধ দল সনির কম্পিউটার তল্লাশি করে তিন শতাধিক নারীর নামসহ ছবি ও ঠিকানার খোঁজ পেয়েছে। এর মধ্যে কিছু ছবি রয়েছে যেগুলো তরুণীদের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের। তিনি মোবাইল ফোনে ফাইল স্থানান্তরের নাম করে পরিচিত এসব নারীর ছবি তাঁর কাছে কপি করে নিয়ে নিতেন। সনি পুলিশকে জানান, তিনি যখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স করেন তখন তাঁর বিষয় ছিল কম্পিউটার সায়েন্স। সেখানে সাইবার সম্পর্কে তিনি কিছুটা দক্ষতা নিয়ে এসব অনৈতিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। তাঁর এই জালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী রয়েছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন সনি।
সাইবার পুলিশ জানায়, সনি হিডেন সফটওয়্যারের মাধ্যমে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সব ছবি, ভিডিও ও লেখা কম্পিউটারে বিশেষ ফাইল তৈরি করে রাখতেন। কিন্তু পুলিশ এসব লুকিয়ে রাখা তথ্য আনলক করে সব অপকর্মের তথ্য বের করেছে।
মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা এসআই শওকত আলম বলেন, ‘সনি বড়মাপের সাইবার অপরাধী। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০ লাখেরও বেশি টাকা ছিল। এখন সেই অ্যাকাউন্টে সাত লাখেরও বেশি টাকার স্থিতি আছে। এই টাকা থেকেই তিনি তথ্য-প্রযুক্তির অন্ধকার পথে খরচ করতেন। আরো তথ্য বের করতে গতকাল শনিবার থেকে পুলিশ তাঁকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।’
এ ব্যাপারে মানসিক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. সুপ্রিয় রায় বলেন, ‘বড় অপরাধীদের এ ধরনের সাইকো সমস্যা থাকে। এই আসামিকে তার কৃতকর্মের শাস্তি দেওয়া না হলে সে ভবিষ্যতে একই ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে।’