স্বাদুপানির অন্যান্য মাছদের মধ্যে গুজি আইড় মাছটি অন্যতম। এই মাছটির স্বাদ অন্যান্য মাছের থেকে একদম আলাদা। বিপন্ন এই মাছটি রক্ষার্থে বাংলাদেশ মাছ গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই ইনস্টিটিউটটি এই মাছটির প্রাকৃতিক প্রজননে সফলতা পেয়েছে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রান্তিক মাছ চাষিরা এই মাছ চাষে এগিয়ে আসছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে যার ফলে এই মাছটির কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন নিয়ে দেখা দিচ্ছে আশার আলো।
তাহলে জেনে নেই এই মাছটির প্রজনন এবং চাষাবাদ সম্পর্কে……
পরিপক্কতাঃ গুজি আইড় মাছ সাধারণত ২-৪ বছরের মধ্যে পরিপক্কতা লাভ করে। তবে ৩-৫ কেজি ওজনের মাছ প্রজননের জন্য বেশি উপযোগী এবং গুনগত মানের পোনা পাওয়া যাবে। গুজি আইড় মার্চ-এপ্রিলে পরিপক্ক হতে শুরু করে।
ডিমের সংখ্যাঃ দেশীয় স্বাদুপানির অন্যান্য অনেক মাছের মতই আইড় মাছের ডিমের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক। মাছের দৈর্ঘ্য ও বয়সের ওপর নির্ভর করে সবর্নিম্ন ২,০০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০,০০০ পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। মাছের দৈর্ঘ্য ও ডিম্বাশয়ের ওজন যদি বেশি হয় তবে ডিমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
প্রজননকালঃ এপ্রিল-মে মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হতে থাকে অথবা বর্ষার শুরুতে প্রজনন করে। অনেক ক্ষেত্রে মার্চ মাসেও এটি প্রজনন করে থাকে। পরবর্তীতে জুলাই-আগস্ট মাসে ডিম ছাড়তে শুরু করে। প্রজননকাল অনেক দীর্ঘ হওয়ায় বছরে দুইবার প্রজনন করতে পারে।
ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা
প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন জলাশয় যেমন বিভিন্ন বড় নদী যেমন যমুনা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, কংস থেকে গুজি আইড়ের ব্রুড সংগ্রহ করা যায়। সিলেট-ময়মনসিংহের হাওরেও গুজি আইড়ের ব্রুড পাওয়া যায়।প্রজননের জন্য পরিপক্ক মাছ তৈরি করতে হলে গুজি আইড় শতাংশে ২.৫-৫ কেজি ওজনের ৮০-১০০ মাছ মজুদ করা যায়।
এই মাছটির চাষ করার ক্ষেত্রে পুকুরের অন্যান্য জলুজ পোকা মাকড়ের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার নিশ্চিত করতে হবে। এই মাছ চাষের একটি অন্যতম উপাদান হল পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখা কেননা পানির প্রবাহ স্বাভাবিক না থাকলে মাছের উৎপাদন ব্যহত হয়। এছাড়াও পুকুরের পানিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে সেক্ষেত্রে প্রতি শতক জমির জন্য ১৫০-২৫০ গ্রাম চুন পনেরদিন দিন অন্তর অন্তর পুকুরের পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এ পদ্ধতইতে মাছ চাষ করলে ৩-৫ মাসের মধ্যেই মাছ প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে থাকে।
প্রজননক্ষম মাছ সনাক্তকরণঃ স্ত্রী মাছের সাথে পুরুষ মাছটি তুলনা করলে দেখা যায় যে, পরিপক্ক পুরুষ মাছের বাইরের দিকে একটি সুস্থ সবল উদগত অংশ দেখা যায় যা স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। অন্য দিকে ইউরিজ্যানিটাল প্যাপিলা ইউরিজ্যানিটাল পোরের উপরে অবস্থান করে যা স্ত্রী মাছে নেই। স্ত্রী-মাছের জেনিটাল প্যাপিলা গোলাকার ও পেট যথেষ্ট ফোলা থাকে। স্ত্রী মাছের পায়ু পথ লালচে ও ফোলা থাকে। স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের চেয়ে আকারে বড় হয়।
প্রজননের জন্য পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছগুলোকে ১:১ অনুপাতে পুকুরে ছাড়া হয়।
প্রণোদিত করার জন্য তিন দিন পরপর পুকুরে পানি সরবরাহ করতে হবে। কিছু দিন পরপর স্ত্রী-মাছের জেনিটাল প্যাপিলা গোলাকার, পায়ু পথ লালচে ও পেট ফোলা আছে কিনা দেখতে হবে। যদি দেখা যায় তবে স্ত্রী মাছটি প্রজননের জন্য প্রস্তুত মনে করা হয়। জলজ আগাছা পুকুরে স্থাপন করা হয় যেন ডিম গুলো ঐ আগাছার নিচে অবস্থান করতে পারে।
সাধারণত পুকুর শুকানোর পর তলদেশে কিছু গর্ত দেখা যায় যা গুজি আইড় মাছ ডিম দেওয়া ও পোনা লালন পালনের জন্য বাসা হিসাবে ব্যবহার করে। পোনা সংগ্রহ করার জন্য জাল ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও পুকুরের পানি শুকিয়েও পোনা সংগ্রহ করা যেতে পেরে। ডিম দেয়ার ১৫-২০ পর পোনা সংগ্রহ করা উচিৎ। সংগৃহিত পোনাগুলি ১.৭০-২.৫ সেমি. দৈর্ঘ্যের ও ৩-৮ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে।
মাছের পোনা বিক্রি করার জন্য একদিন কিংবা দুই দিন অপেক্ষা করতে হবে এসময় সংগৃহীত মাছের পোনা গুলোকে ঝর্নার পানিতে রাখতে হবে।
পোনার নার্সারি নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণে করা হয়ঃ
পুকুর প্রস্তুতি
পুকুর বৃিষ্টর পানির ওপর নির্ভরশীল, তাই পুকুরের গভীরতা এমন হওয়া উচিত যাতে চৈত্র-বৈশাখ মাসেও পুকুরে যথেষ্ট পানি থাকে। পুকুরের গভীরতা ১ -৫ মিটারের মধ্যে রাখতে হবে। আগাছা পরিস্কার ও জাল টেনে অবাঞ্চিত মাছ সরাতে হবে।
মাছ মজুদের পূর্বে প্রতি শতাংশে ১.৫-২ কেজি চুন, ৩-৪ দিন পর পুকুরে মাছের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য (উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা) তৈরির উদ্দেশ্যে জৈব (কম্পোষ্ট ২-৩ কেজি) ও অজৈব (ইউরিয়া ১০০-১৫০ কেজি, টিএসপি ৮০-১০০ কেজি) সার প্রয়োগ করতে হবে।
প্রতি শতক জমির জন্য ২০০ থেকে ২৫০ টি পোনা ছাড়তে হবে। এছাড়াও এসময় পানির গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ২০ দিন অন্তর অন্তর পুকুরের পানি পরিবর্তন করে নিতে হবে। পুকুরের পানির বর্ণ সবুজাভ, বাদামি সবুজ, লালচে সবুজ বা হালকা বাদামী বর্ণের হলে প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি বোঝা যায় এবং পোনা মজুদ করা হয়।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
পোনা ছাড়ার পর থেকেই ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য ২ বার প্রয়োগ করতে হবে এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন পোকা-মাকর ও ছোট চিংড়ি খাবার হিসেবে দেয়া হয়।
পোনাদের খাদ্য হিসেবে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে । প্রোটিন খাবারের পরিমাণ ৩০% হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতদিন দুইবার করে খাবার দিতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন পোকা মাকড় বা চিংড়ি মাছ খাবার হিসেবে দেয়া যেতে পারে। পোনা পুকুরে দেয়ার পর অবশ্যউ ৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রতিশতকে ১৫-২০ দিন অন্তর অন্তর প্রয়োগ করতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্ততঃ এক দিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। অত্যন্ত শীত এবং বৃষ্টির দিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
মাছ আহরণঃ পোনা মজুদের ১০-১২ মাস পর বাজার দর যাচাই করে অল্প পরিমাণে মাছ সংগ্রহ করে বাজারে নেয়া যেতে পারে। প্রথম আহরণ করা হলে ১৫-৩০% হারে বড় সাইজের পোনা মজুদ করতে হবে। পরবর্তীতে মাছ আহরণের জন্যে প্রথমে বেড় জাল এবং পরে পুকুর শুকিয়ে সমস্ত মাছ ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখকঃ কৃষিবিদ তিতুমির (টিটো)
মৎস্য প্রতিবেদন / আধুনিক কৃষি খামার