একেক জাতির ইতিহাসে একেক নেতা কিংবা রাষ্ট্রনায়কের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হয়ে যায়। ১৭৫৭ সালের মীরজাফর এর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে বাংলার জনগণ তার স্বাধীনতা হারায় আর বন্দী হয় ১৯০ বৎসরের জন্য ব্রিটিশদের গোলামীর জিঞ্জিরে। এই জিঞ্জির থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম নেন বাংলার মুক্তির দূত, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বজ্রকন্ঠ। নিজের নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলীর কারণেই খুব অল্প বয়সেই অর্জন করে নেন নিজ এলাকার সকল মানুষের আস্থা। যা পরবর্তীতে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও প্রতীয়মান হয়।
ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবেনা কোন বৈষম্য। মানুষকে অধিকার আদায়ে সচেতন করে তাদের ন্যায্য দাবি অর্জনে সচেষ্ট করে তোলাই যেন ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কিশোর বয়সেই বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করা, ধর্মের নামে অত্যাচার ও হিংসামূলক কর্মকান্ড, শিক্ষার অধিকার আন্দোলনসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পক্ষে সরব ভূমিকা রেখেছেন তিনি। সময়ের আবর্তে সেই টুঙ্গিপাড়ার খোকা হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা।
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) পড়ার সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানীর মত নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসেন এবং রাজনীতির বিভিন্ন কলাকৌশলের দীক্ষা নেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পর পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণ চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ইংরেজরা বিদায় নিয়েছিল সত্য, কিন্তু হাত বদল হয়ে নতুন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এদেশের মাটিতে তার সর্বনাশা নখর বিস্তার করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন যে বাঙালির অধিকার সুরক্ষা ও সকল প্রকারের মুক্তির জন্য স্বাধীনতা অত্যাবশ্যকীয়। তাইতো পাকিস্তানী সরকারের বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদের পাশাপাশি বাঙালি ঐক্যমতের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সক্রিয় হন। পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে বাঙালির স্বাধীনতার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিছুটা আশাবাদী হলেও পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর পশ্চিম পাকিস্তান প্রীতি ও পূর্ব পাকিস্তান শোষণের নীতিতে অচিরেই সে ভুল ভেঙ্গে যায়। ফলে আবার বাঙালির অধিকার আদায়ে সোচ্চার হন।
ধৈর্য্য ও ত্যাগের মহিমায় বলিয়ান শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীকে বাঙ্গালি জাতির ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে বারংবার বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী তাদের শোষণের নীতিতে অটল। তারা বুঝতে পারেনি মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধু কখনই বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন ব্যতীত শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন না।
ভাষা মুক্তিঃ ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে ষড়যন্ত্র পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী করেছিল মুসলিমলীগ মেনে নিলেও বঙ্গবন্ধু তা দৃঢ়তার সহিত প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৪৮ সালে গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, ঢাকার নবাব নাজিম উদ্দিন ও নুরুল আমীনসহ এদেশীয় দোসরগণ যখন পল্টন ময়দান ও কার্জন হলে ঘোষণা দেন, উর্দ্দু, উর্দ্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা তারুণ্য দৃপ্ত কন্ঠের শেখ মুজিব তখন প্রতিবাদী সোচ্চার, না-না। সেই কণ্ঠের সঙ্গে হাজারো কণ্ঠ প্রতিধ্বনি তুললো, “না-না-না, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”। সেদিন রাত্রেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত হলো বাংলার প্রাণপ্রিয় বিপ্লবী ছাত্র সংগঠন “পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ”। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অত্যন্ত ঘৃণিত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ শুরু করেন। মায়ের ভাষার পক্ষে কথা বলায় প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় হতে নাম কেটে দেওয়া হয়। তাতেও কিছু না হওয়ায় সামরিক মদদপুষ্ট সরকারের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। কারাবন্দী থাকা অবস্থাতেই অন্যান্য নেতাকর্মীদের সাথে মিলে ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অর্থনৈতিক মুক্তিঃ
পরিশ্রমী বাঙালি জাতির শ্রমের সঠিক মূল্য নিশ্চয়তার জন্য পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লাহোরে জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বীজ বুনে দেন। তিনি বাংলার কাঁচামালের ব্যবহার করে পরিচালিত কলকারখানাগুলো পূর্র্ব পাকিস্তানে স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণের আহবান করেন। তিনি শাসক গোষ্ঠীকে বাংলার মেহনতি মানুষের শ্রমের প্রকৃত মূল্য পরিশোধ করার জন্যও দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য পাকিস্তানের শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়ে যান। শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান নির্ভর শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তর্জনী উঁচিয়ে দারাজ কণ্ঠে ঘোষণা করেন -“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ভেবেছেন। তিনি বলতেন, এ স্বাধীনতার স্বাদ আমরা গ্রহণ করতে পারব না, যদি না আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে ব্যর্থ হই। তাঁর অর্থনৈতিক আদর্শ ও কৌশল ছিল পরনির্ভরশীলতা ত্যাগ করে নিজস্ব সম্পদের ওপরে দেশকে দাঁড় করানো। অথচ তখন ছিল না পর্যাপ্ত অর্থ, অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি, রফতানি আয় কিংবা শিল্পকারখানা। তখন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল দুর্যোগপূর্ণ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুর দেশ হিসেবে। কিন্তু বাঙ্গালি জাতির প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস থেকে তিনি বলেন, “আছে আমার মানুষের একতা, আছে তাদের ঈমান, আছে তাদের শক্তি”। সেই মানব শক্তিকে নিয়ে তিনি শুন্য থেকে দেশের অর্থনীতিকে অগ্রসর করতে নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি মানুষের মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়নের পথে এগিয়ে চলেন।
১৯৭৪ সালের মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশকে ১৯৭৫ সালে ৩০-৩৫ শতাংশে নামিয়ে, মাত্র তিন বছরেই তিনি বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯৩ ডলার থেকে টেনে ২৭১ ডলারে উন্নীত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছিল তার গণমুখী আধুনিক অর্থনৈতিক দর্শন, প্রবর্তন করেছিলেন আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ার পাশাপাশি ন্যায্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তিঃ
দেশের প্রতিটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে ক্ষুধাহীন ও দারিদ্র্য মুক্ত একটি জাতি গঠনের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলার কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের পরিশ্রমের ফসল পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়ে যাওয়া সহ্য করতে পারেন নি। তিনি সর্বদাই মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন, বলেছেন বঞ্চিত শোষিত মানুষের কথা। স্বাধীনতার পর মুক্তির লক্ষ্যে কৃষির আধুনিকায়নসহ সমবায় কৃষির উপর জোর প্রদান করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন কৃষকরাই সোনার বাংলা গড়ার মূল কারিগর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কৃষিকে শক্তিশালী করতে পারলে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন তো হবেই তদোপরি দেশের অর্থনীতিতেও রাখবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু কৃষকের কথা বলেন, ‘আমাদের চাষিরা সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন না ঘটলে এ জাতির ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়’। এছাড়াও কৃষকের পাশে মেধাবী কৃষিবিদদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উৎসবে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করেন। এবং বলেছিলেন “খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বুঝায় না বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বুঝায়। সুতরাং কৃষি উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্য শস্যের সমন্বিত উৎপাদনে উন্নতি করতে হবে”।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্তির লক্ষ্যে কৃষি উন্নয়নের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুন:সংস্কার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করেন। কৃষি বিষয়ক বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তি চর্চায় মেধা আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জাতির পিতা বলেছেন, “খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার”। বঙ্গবন্ধু বিধ্বস্ত হওয়া কৃষি খাতকে দান করেন এক নবযৌবন। উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন মেধাবী কৃষিবিদদের সহযোগিতায় ও কৃষকের নিরলস পরিশ্রম বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ তাঁর শততম জন্মবার্ষিকীতে ক্ষুধা মুক্ত বাংলার স্বপ্নের অর্জন দেখে যেতে পারতেন।
নারী মুক্তিঃ
বাংলাদেশের মোট জনশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। দেশের অর্থনীতিতে নারীদের সক্রিয় ভূমিকা দেশের উন্নয়নকে বেগবান করবে, এই বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে। তিনি তার সংগ্রামী জীবন শুধুমাত্র বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই উৎস্বর্গ করেননি, তিনি বাঙালি নারীদের কীভাবে বৈষম্যহীন মর্যাদাপূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক অবকাঠামোতে সংযুক্ত করা যায়, সেই ব্যাপারেও সজাগ ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের গঠনতন্ত্রে বহাল নারীদের যে বঞ্চনা ও ধর্মীয় কুসংস্কারের মাধ্যমে পেঁচিয়ে রাখার অপচেষ্টা করে তা থেকে বেরিয়ে আসতে নারী সমাজের প্রতি আহবান করেন। তিনি বিভিন্ন কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নারীদের সম্পৃক্ত করে কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ মহিলা লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নারীদের মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সব পর্যায়ে নারীদের সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিশেষ বিধান প্রণয়নের ক্ষমতাও সংযোজনের ব্যবস্থা করেন (অনুচ্ছেদ ২৭ ও ২৮)। রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(৩)-এর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে ১৫টি সংরক্ষিত আসন রাখার ব্যবস্থা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রমহারা নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সমাজে তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মানকে সমুন্নত করতে ২ লাখ নির্যাতিত নারীকে বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত করেন।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নারীদের সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয় এবং নারীদের চাকরিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ সংরক্ষিত কোটা রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে দুই জন নারীকে মন্ত্রিসভার সদস্য করে নেন এবং ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে একজন নারীকে নিয়োগ প্রদান করেন।
বঙ্গবন্ধু যৌতুক প্রথা থেকে নারীদের মুক্তি দিতে সোচ্চার ছিলেন।
পাশাপাশি নারীদের আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হতেও অনুপ্রাণিত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথাও বলেছেনÑ‘সময় থাকতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা উচিত এবং আমাদের দেশের শিক্ষিত মেয়েদের এগিয়ে আসা উচিত’। তৃতীয় বিশ্বের একটি নতুন স্বাধীন দেশ যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানে গণজীবনে নারীর অংশগ্রহণের অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিঃসন্দেহে নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এছাড়াও তার তত্ত্বাবধানে গঠিত বাকশালে তিনি নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নে নারীর মুক্তি বিষয়টিকে সম্মুখভাবে নিয়ে আসেন।
সাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তিঃ কুসংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্মীয় মূল্যবোধ সমৃদ্ধ মানুষ গঠনের আহবান করেছিলেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতি যে অন্ধকারে নিমজ্জিত তা তিনি বুঝতে পেরে বাঙালিদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসে এবং জনগণ তার আহবানে সচেতন হন। ছাত্রসমাজকে সংঘবদ্ধ করে দেশ ও জনগণের মুক্তির পথ সুগমের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে ধর্মীয় বেড়াজালে মানুষকে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালাতে বাধ্য করে। বঙ্গবন্ধুর মনে হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোন ধর্মীয় কারণে হয় না। এটি কোন গোষ্ঠীর বা রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেছেন, “মানুষ যদি সত্যিকারভাবে ধর্মভাব নিয়ে চলতো তাহলে আর মানুষে মানুষে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এইভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম হতো না”। কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মের অর্থ যার যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে চালাতে চেষ্টা করেছে”। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব ও অধিকারের প্রশ্নে আপোষহীন কণ্ঠের আহবানে বাংলার মানুষ দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে অন্ধকার কুসংস্কারাচ্ছন্নতার পথগামীতা থেকে মুক্তি পায় বাংলার জনগণ। বাংলার মুক্ত বাতাসে নিজ নিজ ধর্মের অনুশাসন মেনে অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি রেখে এক অসাম্প্রদায়িক ও নিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠা হয় স্বাধীন বাংলায়।
স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ঘাতকচক্র বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম এই মহানায়ককে হত্যা করলেও তাঁর নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। তিনি একটি চেতনার নাম বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বাধীনতার রূপকার। এ দেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। জীবিত বঙ্গবন্ধু থেকেও মৃত বঙ্গবন্ধু আরও বেশি শক্তিশালী। যতদিন বাংলাদেশ নামক এই ভূখন্ড থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মাঝে অম্লান হয়ে থাকবেন। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার যে স্বপ্ন দেখেছেন তাঁর আদর্শ ধারণকারী বাংলার সকল জনগণ মনেপ্রাণে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যদিও বিভিন্ন সময় ক্ষমতা লিপ্সায় বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী দেশের উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্তÍ করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সুযোগ্য তনয়া দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বঙ্গবন্ধু যেমন বাঙালি জাতিকে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তেমনি তার সুযোগ্য কন্যা পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রুপান্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিনতকরণের দ্বারপ্রান্তেÍ দাঁড়িয়ে আছে। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে দেখতে পারতেন স্বাধীন বাংলার মেহনতি মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র, কুসংস্কার, অন্যায় নিপীড়ন শোষণ মুক্ত এক জাতি; বঙ্গবন্ধুর ভাষায় যাদের দাবায়ে রাখা যায় না।
লেখকঃ ড. চয়ন গোস্বামী
প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।