নুরুন্নবী চৌধুরী, বিশেষ প্রতিনিধি : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক দুইদিন আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নৃশংস হত্যার বিভৎসতায় মেতে উঠে পাকিস্থানিবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।
মূলত বাংলাদেশ নামক যে দেশের সূচনা হতে যাচ্ছিল সেটিকে রুখে দিতেই পরাজিত বাহিনীর শেষ চেষ্টা ছিলো দেশের এই মেধাবীদের হত্যা করা । যেখানে আমরা হারিয়েছি সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, সংস্কৃতিকর্মীসহ নানান পেশার মানুষ- বাংলাদেশের গুণী-মেধাবীদের।
বর্তমানে প্রযুক্তির এ সময়ে ইন্টারনেট মাধ্যমে বা অনলাইনে মেধাবী এই মানুষদের আত্মত্যাগ ও তাঁদের তথ্যাদি আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একসঙ্গে মেলে না শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিস্তারিত তথ্য। ফলে নতুন প্রজন্ম ঠিকঠাক জানছে না আমাদের সূর্যসন্তানদের।
বর্তমানে ইন্টারনেটে তথ্য খোঁজার হার বেশি। তরুণ থেকে শুরু করে নানা বয়সী ব্যবহারকারীরা নিয়মিত তথ্য খোঁজেন ইন্টারনেটে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখনও যখন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্যাদি খুঁজতে হয়, তখন অনেক তরুণই নানা তথ্যের মাঝে হারিয়ে যান।
সার্চইঞ্জিন গুগলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম লিখে সার্চ করলে নানারকম তথ্য পাওয়া যায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্যাদি না থাকায় সেসব তথ্যাদি পেতে বেশ মুশকিলে পড়ে যান ব্যবহারকারীরা। বেশিরভাগ তথ্যই বিচ্ছিন্নভাবে থাকায় বিষয়গুলো নিয়ে যারা খোঁজ করেন তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এমনই একজন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জাবের আজাদ।
১৪ ডিসেম্বর মহান বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্যাদি খুঁজতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল বিভাগের এই শিক্ষার্থী টেকশহরডটকমকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরেও আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্যাদি ইন্টারনেটে অপ্রতুল। যা কিছু আছে সেগুলোও বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে। নির্দিষ্টভাবে কারও তথ্য খুঁজে পেতে তাই বেশ বেগ পেতে হয়।’
যদিও উন্মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ায় এবং বাংলাদেশের বিশ্বকোষ বাংলাপিডিয়াতে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী। তবে সেখানে নেই পর্যাপ্ত তথ্য, ছবি, ভিডিও বা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে লেখা বই বা অন্যান্য জিনিসের খবর।
শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর টেকশহরডটকমকে জানান, ‘আমার বাবা’র নানা তথ্য সংবাদপত্র বা বইতে আছে। তবে ইন্টারনেটে যে অনেক বেশি আছে তা নয়। আমি নিজের নামে একটি ওয়েবসাইট করেছি যেখানে বাবার নামেও একটি বিভাগ রয়েছে। আশা করছি সেখানে বাবার তথ্যাদি রাখতে পারবো।’
বাবার নামে কোন ওয়েবসাইট করার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে আছে। আশা করছি করতে পারবো।’ তরুণদের কথা ভেবেই এ ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন ‘প্রজন্ম ৭১’ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। সংগঠনটির সভাপতি শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর টেকশহরডটকমকে বলেন, ‘সংগঠন হিসেবে আমরা পুরোনো হলেও আমরা আসলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সকলের তথ্যাদি এক জায়গায় করতে পারিনি। তবে বাংলাপিডিয়ায় আমার বাবা’র তথ্যাদি আমি নিজেই সংযোজনে সহায়তা করেছি।’
সাংগঠনিক ভাবে সকল বুদ্ধিজীবীদের তথ্যাদি নিয়ে অনলাইনে কিছু করার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে আছে সবার তথ্যাদি নিয়ে অনলাইনে কিছু করার।’
নানান মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা নানা তথ্যাদির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও অনেকেই নানা সময়ে আলোচনা করেন। সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্যাদি এক জায়গায় করে অনলাইনে প্রকাশের উদ্যোগ সরকারিভাবে গ্রহণের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের সন্তান অনল রায়হান।
তিনি টেকশহরডটকমকে বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে আমরা পারিবারিক ভাবে অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সেভাবে বাবার তথ্যাদি অনলাইনে এক জায়গায় করার কাজটি করা হয়নি।’
তবে জহির রায়হানের সিনেমাগুলো ফিল্ম আর্কাইভের সঙ্গে মিলে সংরক্ষণের কাজগুলো হয়েছে বলে জানান তিনি।
শিক্ষার্থী জাবের আজাদের বলছেন, ইন্টারনেটে সঠিক তথ্যগুলো থাকা মানে তার মতো অনেক তরুণ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে জানাতে পারে। শুধু তথ্যই নয়, পাশাপাশি তাঁদের কাজ, ছবিসহ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে লেখা বইগুলোর তথ্যাদি অনলাইনে থাকা উচিত বলেও মনে করেন এই তরুণ।
ব্যতিক্রম শহীদ আলতাফ মাহমুদ :
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একমাত্র সঙ্গীতশিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদের নামেই রয়েছে আলাদা এবং পূর্ণাঙ্গ একটি ওয়েবসাইট (www.shahidaltafmahmud.com)। এতে আলতাফ মাহমুদের জীবনী, লেখা উপন্যাস, সম্মাননা, অডিও এবং ভিডিও গ্যালারি ইত্যাদি রয়েছে।
শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১৪ সালে এ ওয়েবসাইটটি চালু করা হয় বলে জানান আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ।
টেকশহরডটকমকে তিনি বলেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের উদ্যোগ না হলে একটা সময় ‘আলতাফ মাহমুদ’ নামটাই মুছে যাবে। অনেক তো অপেক্ষা করলাম, না হওয়ায় নিজেদের স্বার্থেই এ ওয়েবসাইট শুরু করা।’
ওয়েবসাইটটিতে নানা ধরনের তথ্যাদির পাশাপাশি রয়েছে অনেক ধরনের ছবি। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতি বছর একজনকে সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। ওয়েবসাইটে প্রতিবছরের সম্মাননা প্রাপ্তদের ছবি, তথ্যাদিও রয়েছে।
শাওন মাহমুদ বলছেন, ‘বাবার অন্তর্ধান দিবসে আসলে বাবাকে স্মরণ করার জন্য আমরা প্রতি বছর এ সম্মাননা দেই। যারা সংস্কৃতিমনা, তরুণ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরেও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে তাদেরকেই মূলত এ সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। এবং তাদের এ তথ্যগুলোও ওয়েবসাইটে রাখা হচ্ছে।’