টেকশহর কনটেন্ট কাউন্সিলর: অস্ট্রেলিয়ায় ২০১০-১১ সালের ভয়াবহ বন্যায় গোটা কুইন্সল্যান্ড ভেসে গিয়েছিলো । অনেক মানুষের প্রাণহানি সঙ্গে শত শত কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছিলো রাজ্যটির। শুধু তাই নয় বন্যায় ১৯ হাজার কিলোমিটার রাস্তা ভেঙ্গে পড়ে , ফলে অঞ্চলটিতে তখন জরুরী পণ্য সরবরাহ কঠিন হয়ে যায়। এটি ছিলো কুইন্সল্যান্ডের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তাগুলো আবহাওয়া নিরোধক করে তোলার প্রয়োজনীয়তা বোঝার একটি বড় শিক্ষা।
এরপর থেকেই কুইন্সল্যান্ড রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে ফোমড বিটুমিন স্ট্যাবিলাইজেশন প্রক্রিয়া গ্রহন করে। এ প্রক্রিয়ায় গরম বিটুমিনের মধ্যে অল্পমাত্রায় বাতাস এবং ঠান্ডা পানি মেশানো হয়। এই আঠালো কালো পদার্থটি সাধারনত রাস্তার উপরের অংশের জন্য ব্যবহৃত হয়। এরপর বিটুমিন প্রসারিত হয় এবং রাস্তার উপরে পানিনিরোধক স্তর গঠন করে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা কুইন্সল্যান্ডের মতো বিশ্বের অনেক স্থানেই এখন ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে উঠেছে। ওয়ার্ল্ড রোড অ্যাসোসিয়েশনের (পিআইএআরসি) জলবায়ু পরিবর্তন এবং রোড নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান ক্যারোলিন ইভানস বলেছেন, ‘এটি আসলে ২০১৭ সালে কুইন্সল্যান্ডের রাস্তায় গ্রীষ্মকালীন ঘূর্ণিঝড় ডেব্বির সময় পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিলো। যখন পানি সরে গিয়েছিল তখনও রাস্তাগুলো অক্ষত ছিলো, ফলে সেসময় পুরোপুরি পুনবাসনের প্রয়োজন হয় নি।’
কুইন্সল্যান্ডের রাস্তাগুলো বন্যার পানি নিরোধক করে তোলার জন্য অন্যান্য রাস্তাগুলোতেও ফোম বিটুমিন স্ট্যাবিলাইজেশন ব্যবহার করা হয়। গতানুগতিক পিচ ঢালাইয়ের (অ্যাসফল্ট) তুলনায় এই পদ্ধতি অনেক বেশি সাশ্রয়ী।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রাস্তা-ঘাট সুরক্ষিত রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নানাপদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব পদ্ধতির মধ্যে ফোম বিটুমিন স্ট্যাবিলাইজেশন একটি। নেপালের ভূমিধ্বস-অবরুদ্ধ রাস্তা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ভেসে যাওয়া উপকূলীয় মহাসড়ক, কেনিয়ার ভেঙ্গে পড়া সেতু, কানাডার বরফগলা রাস্তাঘাট- এ সব কিছুই ক্রমে উষ্ণ হয়ে উঠা জলবায়ুর ফলাফল। জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন নেটওয়ার্ককে হুমকির মুখে ফেলেছে।
অবশ্য মুদ্রার অপরপিঠের মতো পরিবহন নেটওয়ার্কে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরুপ প্রভাব উদ্ভাবনের নতুন শক্তির বিকাশ ঘটাচ্ছে।
রাস্তাগুলির অন্যতম বড় সমস্যা উচ্চ তাপমাত্রা। অতিরিক্ত তাপ ফুটপাথগুলিকে নরম করে, আরো বেশি ফাটল তৈরি করে এবং পৃষ্ঠের নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার কাউন্সিল ফর সাইন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের গবেষণা প্রকৌশলী রেফিলোয়ে মোকেয়েনা বলেছেন, স্থানীয় পরিস্থিতির উপর মূলত প্রকৃত প্রভাব নির্ভর করে। রাস্তার ব্যর্থতার জন্য আরো অনেক কারন রয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে রাস্তাগুলো কার্যক্ষম থাকতে ব্যর্থ হতে পারে।’
তাপ থেকে রাস্তাগুলোকে রক্ষার জন্য ঢাল বা হিট শিল্ড নির্মান করা একটি সমাধান হতে পারে। এগুলো বিশেষ আবরন এবং ক্ষুদ্র ফাঁপা সিরামিক কণা যা রাস্তার রং হালকা করে সৌর বিকিরণ প্রতিফলিত করে। এ প্রসঙ্গে পিআইএআরসি’র ইভানস বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই হিট শিল্ড রাস্তার উপরের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে।’ এটি ‘হিট আইল্যান্ডের’ প্রভাবকেও কমাতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। যেখানে চারপাশের উঁচু উচু ভবনের কারনে বাতাস চলাচল করতে না পারার কারনে পাশ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় কোন কোন শহর বেশি উষ্ণ হয়ে উঠে।
অলিম্পিক ২০২০ আয়োজনের সময়ে টোকিও নিপ্পন করপোরেশনের তৈরি সোলার-ব্লকিং পেইন্ট কোটিং ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলো। কোম্পানিটির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিলো দেশের তিন মিলিয়ন বর্গ মিটার রাস্তার উপরের স্তরে এই সোলার হিট ব্লকিং পেইন্ট ব্যবহার করা হবে। অবশ্য এ ধরনের কোটিং রাস্তার ওপরের স্তরকে রক্ষা করলেও জনসাধারনের চলাচল স্বস্তিদায়ক করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় দেখা গিয়েছে রাস্তায় কোটিংয়ের কারণে উপরের স্তরে উল্লেখযোগ্য পরিমানে তাপ বিকিরিত হয়।
তবে এসব খরচের কথা ভেবে এ ধরনের প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহন না করা হলে ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়বে। যদি তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি থেকে প্রতিরোধকমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা না হয় তাহলে ২১০০ সাল নাগাদ আফ্রিকার রাস্তাঘাটগুলো মেরামতের ব্যয় ১৮৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছুবে বলে জানিয়েছে কলরাডোা বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে মেরামতের চেয়ে এর বিকল্প খুঁজছে এখন বিশ্বের অনেক দেশই।
এদিকে রাস্তার জন্য বিকল্প প্রযুক্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আগ্রহ থাকলেও এক্ষেত্রে বিনিয়োগে দেশভেদে ভিন্নতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন খরচের কথা ভাবলে গোটা সড়ক নেটওয়ার্কের পরিবর্তে ‘ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো আধুনিকায়ন করা যায়।’ এছাড়া সবসময়ই যে উচ্চপ্রযুক্তির উপাদান এবং প্রক্রিয়া প্রয়োজন হবে সেটিও নয়। তুলনামূলক কম গাড়ি চলাচল করে এমন রাস্তার ক্ষেত্রে মাটির মতো কম কার্বন নিঃসরন উপাদান এবং ভারী দূষণকারী যন্ত্রপাতির তুলনায় মানবকর্মীদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়া যায়। এছাড়া কিছু কিছু দেশের ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল উপাদান প্রয়োজনও হয় না।
বিবিসি/আরএপি