গোল মরিচ একটি মসলা জাতীয় অর্থকরী ফসল। খাবারকে সুস্বাদু করতে এবং বিভিন্ন ভেষজ ওষুধের সাথে এর ব্যবহার দেখা যায়। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মসলা হল এই গোলমরিচ। গোলমরিচ লতাজাতিয় উদ্ভিদ। পান গাছ, ওদাল, বেত ইত্যাদির মত গোলমরিচ এক পরাশ্রয়ী গাছ। আম, সুপারী, কাঁঠাল, মান্দার, তেঁতুল, নারিকেল, তাল, খেজুর ইত্যাদি গাছ গোলমরিচের আশ্রয়ী গাছ হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া অমসৃণ ছাল থাকা গাছে গোলমরিচ গাছ ওঠার জন্য ভাল হয়।
গোল মরিচের গুণাগুণ
১. গোল মরিচ রুচি ও খিদে বাড়ায়
২. গোল মরিচ কফ ও কাশি দূর করে
৩. কৃমি জাতীয় রোগ প্রতিরোধ করে
৪. গলার সংক্রমণ রোধে সহায়তা করে
৫. দাঁতের ব্যাথা সারাতে সহায়তা করে
৬. বমিভাব কমায়
৭. পায়োরিয়ার ক্ষেত্রে বেশ উপকারি
চারা উৎপাদন
সাধারণত গোলমরিচের চারা ডালের কলম থেকে তৈরি করা হয়। গোলমরিচের গাছের গোড়ার অংশকে ´রানার´ বলা হয়। রানারের প্রতিটি গাঁট থেকে শিকড় বের হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে। রানারের প্রতি তিনটি গাঁটের একটি অংশ কেটে নিয়ে আশ্রয়ী গাছের কাছে ´সরা´ লাগিয়ে দিতে হয়। মাটির সঙ্গে ৩ : ১ অনুপাতে দাগ দিয়ে একটি পালং তৈরি করে তাতে গোলমরিচের ডাল থেকে তিনটি গাঁটযুক্ত কলম কেটে লাগাতে হবে। এক থেকে দেড় মাস পর ওই কাটিং থেকে শিকড় বেরিয়ে আসবে। তখন পলিথিন ব্যাগে ৪ ইঞ্চি করে ৩ ভাগ দো- আঁশ মাটি ভর্তি করে ওই শিকড়যুক্ত কাটিং থেকে সাবধানে উঠিয়ে পলিথিন ব্যাগে লাগিয়ে দিতে হবে। রোপণের পূর্বে বাঁশের কাঠি দিয়ে পলিথিন ব্যাগের মাটিতে গর্ত করে নিয়ে শিকড়যুক্ত কাটিং লাগাতে হবে। দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে একটি সুন্দর চারা গজাবে। সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাস চারা উৎপাদনের পক্ষে উপযোগী।
বংশ বৃদ্ধি
গোলমরিচের বংশ বৃদ্ধি গোলমরিচের বীজ থেকে করা যায়। এতে উৎপাদনে আসতে বেশি সময় লাগে। গোলমরিচের গুণাগুণ মাতৃগাছের মত না-ও হতে পারে। সেজন্য সাধারণত অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে গোলমরিচের বংশবৃদ্ধি করা ভাল। সাধারণত এক মুকুল একপত্রীকাটিং -এ বংশবৃদ্ধি করা হয়। এ পদ্ধতি থেকে খুব সহজে গোলমরিচের চারা উৎপাদন করা যায়। শাখা রোপণে গাছ তৈরি হয় এবং গাছগুলো খুব সহজে বড় হতে থাকে।
আশ্রয় গাছ হিসেবে মান্দার গাছ গোলমরিচের জন্য ভাল। এ গাছটি সোজাভাবে বাড়ে এবং শাখা-প্রশাখার সংখ্যা কম থাকে। গাছের ছাল অমসৃণ এবং এ থেকে এক প্রকার আঁঠা জাতীয় পদার্থ বের হয়। মান্দার গাছের শাখাগুলো যখন গোলমরিচ গাছের উচ্চতা সীমিত রাখার জন্য কাটতে হয়, তখন কোন অনিষ্ট হয় না। মান্দার শুটি জাতীয় গাছ। ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন মাটিতে ধরে রাখতে পারে। এতে মাটি সমৃদ্ধ হয়।
গর্ত তৈরি ও চারা রোপণ
গোলমরিচের চারা দুই ভাবে রোপণ করা যায়। যদি বাগানে সুপারি, নারকেল, আম, মান্দার, কাঁঠাল ইত্যাদি আশ্রয় গাছ হিসেবে ব্যবহারের গাছ থাকে, তখন ওই গাছ থেকে দুই ফুট দূরে, দুই ফুট দৈর্ঘ্য, দুই ফুট প্রস্থ এবং দুই ফুট গভীর গর্ত করতে হবে। গোবর, পচনসার, বালিযুক্ত মাটি দিয়ে গর্তটি পূরণ করে চারা রোপণ করা যায়। গাছ গজানোর সুবিধার জন্য বাঁশের অবলম্বন দেয়া যেতে পারে।
নতুন জায়গায় গোলমরিচের চাষ করতে হলে প্রথমে আড়াই হাত থেকে চার হাত দূরত্বে দেড় ফুট দৈর্ঘ্য, দেড় ফুট প্রস্থ এবং দেড় ফুট গভীর গর্ত করে উপরের উল্লেখ করা মত গর্ত পূরণ করতে হবে এবং সেখানে আশ্রয় গাছের দক্ষিণ দিক ছেড়ে চারা লাগাতে হবে একই নিয়মে। প্রয়োজনে চারাগাছে ছায়া দেয়া যেতে পারে। প্রতি হেক্টরে ২৭৫ থেকে ৩০০ টি চারা লাগে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
১। গোল মরিচ গাছে অনুমোদিত সার প্রয়োজন ও পরিমান মত দিতে হবে। সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় চৈত্র-বৈশাখ মাস।
২। গোল মরিচ চাষ করার ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রতি গর্তে ১০ কেজি কম্পোস্ট বা গোবর সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে।উল্লেখিত সার সমান দুই ভাগে ভাগ করে দিতে হবে।
গোলমরিচ গাছের যত্ন
গোলমরিচের লতাগুলো দ্রুত বৃদ্ধির জন্য আশ্রয় গাছের সাথে বেঁধে দিতে হবে। গাছের গোড়া থেকে ৩ হাত উপর পর্যন্ত- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গোলমরিচ গাছ যাতে ৯ হাতের বেশি বড় হতে না পারে সেদিকেও বিশেষ খেয়াল রাখাতে হবে।
প্রয়োজনীয় জলবায়ু ও মাটি
১। অব্যবহৃত বা পতিত জমিতে উচ্চ জৈব সার সমৃদ্ধ পানি জমে না থাকা, পাহাড়ের লালমাটি গোলমরিচ চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
২। বন্যা কবলিত অঞ্চল ছাড়া বেলে দো-আঁশ মাটিতে গোল মরিচের চাষ করা যায়। পাহাড়ি ঢাল ও টিলার অনাবাদি জমি হল গোলমরিচের চাষের জন্য উত্তম জায়গা।
৩। গোলমরিচ চাষের জন্য এমনও মাটি হওয়া দরকার যে মাটি খুব শুষ্ক হবে না এবং প্লাবিত ও আর্দ্র হবে না।
গোলমরিচের জাত
গোল মরিচের বিভিন্ন জাত রয়েছে। যেমন-১ (হাইব্রিড), কারিমুণ্ডা, বালনকাট্টা, কল্লুভেল্লি, আরকুলপাম মুণ্ডা প্রভৃতি।
গোলমরিচের চাষ করার সময়
গোলমরিচ সাধারণত ভাল জাতের গাছ বা বীজ বৈশাখের ১০ থেকে ১৫ দিন থেকে আষাঢ়ের ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন- চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
রোগ-বালাই ও পোকামাকড়
১। গোলমরিচে তেমন কোন রোগ-বালাই দেখা যায় না, তবে এক প্রকার ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়। যা ফলের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে।
প্রতিকার
শ্রাবণ ও কার্তিক মাসে প্রতি ৫ লিটার পানিতে এক চা চামচ ´এন্দোসালফার ৩৫ ইসি´ বা কুইনলফস বা ডাইমিথয়েট ৩০ ইসি প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া যায়।
২। এছাড়াও মাঝেমধ্যে গোলমরিচ গাছে স্কেল বা খোস পোকা, কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, ডগা ছিদ্রকারী পোকা, ছাতরা পোকা, গল, থ্রিপস ইত্যাদির আক্রমণ দেখা যায়।
ফসল সংগ্রহ
গোলমরিচের ছড়িতে যখন দু´একটি গোলমরিচ হলুদ রঙের হয় তখন মই দিয়ে উপরে উঠে ফসল কেটে নিয়ে ছড়িগুলো মেলে রাখতে হবে। গোলমরিচগুলো পৃথক করে ৪-৫ দিন রোদে শুকাতে হবে। গোলমরিচ ভালভাবে শুকিয়ে গেলে কালো ও আকারে ছোট হয় এবং তারপর বাজারজাত করা যায়।