ছবি: বিবিসি
টেকশহর কনটেন্ট কাউন্সিলর: ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পুরো বিশ্ব প্রত্যক্ষ ও ডিজিটালভাবে এক অদ্ভূত সময়ে জড়িয়ে পড়েছে। মেটা,গুগল এবং অ্যাপলের মতো করপোরেট জায়ান্টরা যারা এতোদিন নিজেদেরকে নিরপেক্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করে আসছে তাদের মধ্যেই এখন নানা রাজনীতির রং।
ইতোমধ্যে রাশিয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। একদিকে টুইটার ও ফেইসবুক বøক অন্যদিকে টিকটকও রাশিয়ার ব্যবহারকারীদের পোস্ট প্রকাশ করছে না। শুধু তাই নয় রাশিয়ার রাস্তাঘাটে কেউ মোবাইল দেখলে পুলিশ তাদের থামিয়ে রীতিমতো জেরা করছে।
তাই এখন বলা হচ্ছে সংঘাত শুধুমাত্র বিশ্বের ভূগোলকেই পরিবর্তন করে না মৌলিকভাবে বৈশ্বিক ইন্টারনেটের গতিপ্রকৃতিও বদলে দিচ্ছে।
রাশিয়া কি বৈশ্বিক ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে?
ইউক্রেন সরকার নিজস্ব প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে রাশিয়ায় সেবাপ্রদান বন্ধ রাখতে বলেছে। এছাড়াও রাশিয়ায় ব্যবসা অথবা পণ্য বিক্রি করবে না এমন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিনে দিনে দীর্ঘ হচ্ছে। এখন ইউক্রেনের প্রযুক্তিবোদ্ধা নেতারা আরো বড় কিছুর দাবি করছে- তারা চাইছে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট থেকে রাশিয়াকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হোক। তবে এ আহŸানের জবাব জোরালভাবে ‘না’ করে দিয়েছে আইসিএএনএন (দ্য ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস)। ডটআরইউ’র মতো রাশিয়ার শীর্ষপর্যায়ের ডোমেইনগুলোর সাথে দেশটির সিকিউর সকেটস লেয়ার (এসএসএল) সার্টিফিকেটও প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়েছিলো সংস্থাটিকে।
কিন্তু সংস্থাটির স্লোগান ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড, ওয়ান ইন্টারনেট’ এবং ইউক্রেনের উপ প্রধানমন্ত্রী মাইখাইলো ফেডরভকে জানানো প্রতিক্রিয়া হিসেবে আইসিএএনএনর প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা গোরান মারবি বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ি আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখি এবং আন্তর্জাতিক ইন্টারনেটের সমর্থনে কাজ করি। শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা ইন্টারনেটের পরিধি সীমাবদ্ধ করার পাশাপাশি উসকানিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা আমাদের মিশন নয়।’
ডিজিটাল প্রাইভেসি গ্রæপ ইলেক্ট্রোনিক ফ্রন্টেয়ার ফাউন্ডেশনসহ (ইএফএফ) বেশ কয়েকটি সংস্থা আইসিএএনএন’র এই সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়েছে।
ইএফএফ এর কর্নি ম্যাকশেরি এবং কনসট্যানটিয়ন কমাইটিস এক বিবৃতিতে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যুদ্ধের সঙ্গে ইন্টারনেটের ঝামেলা করার কোন সময় নেই। মৌলিক ইন্টারনেট প্রটোকলে হস্তক্ষেপ ‘অনেক বিপদজনক এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বয়ে আনবে।’
সাইবার হামলার বিরুদ্ধে সুরক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠান ক্লাউডফ্লারকেও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার আহŸান জানিয়েছিল ইউক্রেন। একটি বøগে প্রতিষ্ঠানটি এ প্রসঙ্গে জানিয়েছে, তারা অনুরোধটি বিবেচনা করছে। তবে বøগের শেষে ক্লাউডফ্লার জানান, ‘রাশিয়ার আরো বেশি ইন্টারনেট অ্যাকসেস প্রয়োজন, কম নয়।’
স্প্লিন্টারনেট কি এবং কিভাবে কাজ করে?
অনেকের কাছেই রাশিয়াকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান ছিলো স্প্লিন্টারনেট নামে পরিচিত বিপদজনক গর্তে পা ফেলার মতো। স্প্লিন্টারনেট মূলত দেশভেদে ইন্টারনেটের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করনের কথা বলা হয়।
চীনের গ্রেট ফায়ারওয়াল হচ্ছে একটি দেশের নিজস্ব ওয়েব তৈরির সবচেয়ে ভালো উদাহারন। অন্যদিকে ইরানেও নেটের যাবতীয় কনটেন্ট খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত¡ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি অব ইরান বাহির থেকে আসা যাবতীয় তথ্য নিয়ন্ত্রন করে।
অন্যদিকে রাশিয়া নিজেই বেশ কয়েক বছর ধরেই রানেট নামে একটি সার্বভৌম ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। ২০১৯ সালে রাশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো তারা এই ব্যবস্থাটি সফলভাবে পরীক্ষা করেছে। তখন খুব কম লোকই এর প্রয়োজনীয়তা বোঝতে পেরেছিলো। কিন্তু ইউক্রেনে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ‘এটি আরো বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে’ বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব সুরেইয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী প্রফেসর অ্যালান উডওয়ার্ড।
তখনকার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রাশিয়ার আইএসপিগুলোকে একটি জায়ান্ট ইন্ট্রানেটের মতো নিজেদের সীমানার মধ্যেই ইন্টারনেটের একটি কনফিগার করতে বলা হয়েছিলো। এই পদক্ষেপের মধ্যে রাশিয়ার সংস্করনের নেটটি আন্তর্জাতিকভাবে সংযোগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছিল। রাশিয়া এখন এই ব্যবস্থাগুলো পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। রাশিয়া সরকারের একটি মেমোতে দেখা গিয়েছে এইএসপিগুলোকে তাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে এবং রাশিয়ার ডোমেইন নেইম সিস্টেম (ডিএনএস) সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মেমোর তথ্যানুযায়ি ১১ মার্চ এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়েছে; অনেকে ধারণা করছেন এর অর্থ রাশিয়া অচিরেই বৈশ্বিক ইন্টারনেট থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন্ করতে চেয়েছিলো।
যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করে বলা হয়েছে বিদেশি সাইবার হামলা থেকে রুশ ওয়েবসাইটগুলোকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তারা এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলো।
তবে গ্রেট ফায়ারওয়াল অব চায়নার লেখব জেমস গ্রিফিথস মনে করেন যে কোন সময় রাশিয়া আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। তিনি বিবিসিকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অর্থ রাশিয়াবাসী সেইসব কনটেন্টই পাবে যা ক্রেমলিন প্রকাশের অনুমোদন দিবে। আগামি কয়েক মাস বা সপ্তাহের মধ্যে এটি কার্যকর হলে আমি খুব একটা অবাক হবো না।’
এর প্রভাব কি হবে?
দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ভার্টিক্যল: হাউ টেকনোলজি ইজ রিমেকিং গ্লোবালাইজেশন বইটির লেখক অবিশুর প্রকাশ মনে বরেন যুদ্ধ ইন্টারনেটের রূপ বদলে দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ভূরাজনীতির কারনে ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের ইন্টারনেটের উত্থান হচ্ছে। যেখানে বিভিন্ন দেশ হয়তো নিজেই আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে অথবা নিজস্ব বিকল্প তৈরি করে নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো বৈশ্বিক সেতুগুলো যা বিশ্বের মানুষকে কয়েক দশক ধরে বেধে রেখেছে তা এখন ভেঙ্গে পড়ছে।’
নেট ক্ষমতার নতুন অক্ষটি এখন পশ্চিমা এবং চীন/রাশিয়ার মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন জেমস গ্রিফিথস। তিনি বলেন, ‘চীনের গ্রেট ফায়ারওয়ালের প্রতিষ্ঠাতা ফ্যাং বিনঝিং ২০১৬ সালে রাশিয়ায় এসেছিলেন। তারা কি কাজ করছে এবং চীনের মতো করেই রাশিয়ার ফায়ারওয়াল তৈরির দিকনির্দেশনা দিতেই তিনি এসেছিলেন।’
বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো সেবা ও পণ্য প্রত্যাহার করে নেয়ার পর রাশিয়া আরো একবার চীনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গ্রিফিথস বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির অনেক দিক থেকেই রাশিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তারা এখন চীনের দিকে তাকিয়ে। অতীতের মতো তারা আবার চীনের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।’
বিবিসি/আরএপি