সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৫৬ অপরাহ্ন

বিভীষিকাময় সেই ২১ আগস্ট ‘মানবঢাল’ দিয়ে রক্ষা করা হয়েছিল নেত্রীকে ‘জয় বাংলা’ বলতেই শুর হয় গ্রেনেড বিস্ফোরণ

সাইফুল ইসলাম
  • Update Time : সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০২৩
  • ৯৫ Time View

বিভীষিকাময় সেই ২১ আগস্ট ‘মানবঢাল’ দিয়ে রক্ষা করা হয়েছিল নেত্রীকে ‘জয় বাংলা’ বলতেই শুর হয় গ্রেনেড বিস্ফোরণ

সাইফুল ইসলাম: আজ ২১ আগস্ট। বিভীষিকাময় একটি দিন। ২০০৪ সালের এদিনে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্য গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।

দিনটি ছিলো শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। হাজার হাজার মানুষের স্রোত ছিল সমাবেশটিতে। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে যাওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিকেল ৫টার একটু আগে সমাবেশস্থলে পৌঁছান বিরোধী দলের নেতা। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য দেন।

সময় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলতেই শুরু হয় একের পর এক ভয়ঙ্কর গ্রেনেড বিস্ফোরণ। এক থেকে দেড় মিনিটের ব্যবধানে বিস্ফোরিত হয় ১৩টি গ্রেনেড। নৃশংস সেই গ্রেনেড হামলায় দলের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ জন। শেখ হাসিনাসহ আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে খই ফোটার মতো একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় ঘাতকরা। কিছু বুঝে উঠার আগেই গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। রক্তগঙ্গা বইয়ে যায় এলাকাজুড়ে। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা।

চারদিকে তখন রক্ত আর বিচ্ছিন্ন হাত-পা পড়েছিল। দাউ দাউ করে জ্বলছিল গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণে আগুন ধরা গাড়ি। ছিন্নভিন্ন শরীর নিয়েই অনেকে বাঁচার জন্য আকুতি করছিলেন। এর মধ্যেও ‘মানবঢাল’ তৈরি করে হামলা ঠেকিয়ে কোনোমতে প্রাণে রক্ষা করা হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। ওই হামলায় অনেকে বেঁচে গেলেও এখনও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।

সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের মহানগরের সভাপতি নাসিমা ফেরদৌস। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, প্রোগ্রামের সময় আইভি আপাসহ আরও অনেকের সঙ্গে ট্রাকের সামনে ছিলাম। নেত্রী বক্তৃতা শেষ করার আগে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। কয়েক জায়গায় আগুন ধরে যায়। আইভি আপা রাস্তায় পড়ে গেলেন। মুহূর্তেই নেতাকর্মীরা নেত্রীর চারপাশ ঘিরে ফেলেন। আমি দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পারছিলাম না। পেটে কিছু ঢুকে গেছে এমনটা মনে হচ্ছিল। পা উড়ে গিয়ে কোনোরকমে লেগেছিল। ডান কাঁধে তাকিয়ে দেখি লাল রক্ত। চারপাশে মানুষজন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এর মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এভাবে কিছু সময় যাওয়ার পর নিজেকে একটি লাশের ট্রাকে আবিষ্কার করি। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে এক সাংবাদিক কাছে এসে পরিবারের কারও মোবাইল নাম্বার জিজ্ঞাসা করছিলেন। অনেক কষ্টে বড় ছেলের নাম্বার মনে করার চেষ্টা করি। পরে ওই সাংবাদিক ভাই কল করে ছেলেকে আমার অবস্থা জানান।

তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাক থেকে আমাকে ঢাকা মেডিকেলের ফ্লোরে এনে শোয়ানো হয়। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ভাইসহ আরও কয়েকজন এসে আমাকে চিনতে পারেন। নয়তো আমার লাশও স্বজনরা খুঁজে পেত কি না সন্দেহ। এর মধ্যে আমার বড় ছেলে এসে আমাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যায়। সেখানে অপারেশন শুরু করতে গেলে রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। আবার যখন রক্ত মেলে তখন রক্ত নেওয়ার ব্যাগ মিলছিল না। এভাবে রাত পার হয়ে যায়। সেখানে সকালে অপারেশন শুরু হলে চিকিৎসকরা পা কেটে ফেলার কথা বলেন। প্রথমে ছেলেরা বাধা দেয়। পরে চিকিৎসকরা পা কেটে ফেলেন।’

সেদিন গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে ফেরাদের আরেকজন হলেন, সাভারের মাহবুবা পারভীন। ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন তিনি। বর্তমানে ঢাকা মহানগর উত্তরের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি।

সেদিনের বিভীষিকাময় ঘটনার কথা মনে করে তিনি বলেন, সেদিন সকালে সাভারে ছিলাম। কেন্দ্রীয় নেতারা কল করে প্রোগ্রামের কথা জানালে দুপুরের আগেই ঢাকায় চলে আসি। প্রোগ্রাম শুরুর আগে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে পৌঁছে যাই। এখানে এসে দেখি অনেক মানুষের ভিড়। নেতাকর্মীদের ভিড় ঠেলে প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই মঞ্চের কাছে চলে যাই। একটি ট্রাকে মঞ্চ করা হয়েছিল। শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় নেতারা একে একে বক্তৃতা করেন। শেষের দিকে নেত্রী মঞ্চে এলে স্লোগানে স্লোগানে পুরো এলাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। নেত্রী আসবেন এ কারণে প্রোগ্রামে বহু মানুষ হাজির হয়েছিল।

এই নেত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য শেষ করে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলবেন, ঠিক এমন সময় হঠাৎ করে বিকট শব্দে একটি বিস্ফোরণ হয়। পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পর পর আরও কয়েকটি বিস্ফোরণ হয়। দেখি আমার ডান হাত ও বাম পা কাজ করছে না। নিচে তাকিয়ে দেখি আইভি আপাসহ বহু নেতাকর্মী রাস্তায় পড়ে আছেন। সবার শরীর রক্তে ভাসছে। রাস্তায় রক্তাক্ত হয়ে আরও অনেকে পড়ে আছেন। বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি করছিলেন নেতাকর্মীরা।

তিনি বলেন, বিস্ফোরণের পর পরই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম যে, নেত্রীকে হত্যার জন্য পরিকল্পিতভাবে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। তখন সবার একটিই চিন্তা ছিল নেত্রীকে বাঁচানো, বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বাঁচানো। ওই সময় মঞ্চের কাছে থাকা নেতাকর্মীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে মানবঢাল তৈরি করে নেত্রীকে চারপাশে ঘিরে রাখেন। যারা হামলায় কম আহত হয়েছেন তারা গুরুতর আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যেতে থাকেন। আমি রাস্তায় পড়েছিলাম। দীর্ঘ সময় এভাবে পড়ে থাকার পর তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আশীষ কুমার সিংহ আমাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন। তিনি একটি অ্যাম্বুলেন্স এনে অনেকের সঙ্গে আমাকেও ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে সিট ফাঁকা না থাকায় বারান্দায় রেখে চিকিৎসকদের কাছে ছোটাছুটি করেন। এভাবে কিছু সময় যাওয়ার পর কোনো উপায় না পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানেও আহত মানুষের ভিড় ছিল অনেক। যাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল তাদের আগে আগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। গ্রেনেডের আঘাতে আমার একপাশ প্যারালাইজড হয়ে যায়।

কারও হাত নেই, কারও পা উড়ে গেছে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো পথ। অস্থায়ী সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে রক্তের অনাহূত আল্পনা, শত শত মানুষের আর্তচিৎকার। বেঁচে থাকার জন্য, প্রাণ বাঁচানোর জন্য মুমূর্ষুদের আকুতি, কাতর আর্তনাদসহ অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্যর কথা উল্লেখ করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
©২০২৩
Designer: Shimulツ
themesba-lates1749691102